হনহন করে ছুটে চলছে রহিম। ক্লান্তিকে পা দিয়ে ঠেলে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কাঁদাযুক্ত পথে বেশি হাটা যায় না। কিন্তু তবুও তাকে যেতেই হবে। এ যে তার দেওয়া প্রতিশ্রুতি। যেভাবেই হোক পাঁচটার আগে তার কমলপুর পৌঁছতে হবে। ট্রেন ছাড়ার সময় সন্ধ্যা সাতটা।
হাঁটার মধ্যেই তার মনে পড়তে লাগলো গতমাসের সেই স্বরণীয় দিনগুলোর কথা। যখন প্রথম সুলতানার সাথে দেখা হয়, সেই দিনটির কথা।
কমলপুর গ্রামের বড় বাজারে ফজল আলী মিস্ত্রির ফার্নিচারের দোকানে কাজ করতো সে। রহিম কাম কাজ খুব মনোযোগ দিয়ে করতো বলে ফজল আলীও তার ক্বদর করতো। একদিন রহিমের ডাক আসে কমলপুরের চেয়ারম্যান হাবিব মিয়ার বাড়িতে। চেয়ারম্যান সাহেবের ঘরের কিছু আসবাব পত্র তৈরী করবেন, সেজন্যই রহিমকে ফজল আলী পাঠিয়ে দিলো চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়িতে।
রহিম চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়ির বাইরে থেকে ডাক দিলো। চেয়ারম্যান সাহেবের কাজের লোক খলিল তাকে নিয়ে গেলো জিনিসপত্রের মাপ জোক নেওয়ার জন্য।
বাড়িতে ঢুকেই রহিমের অনেক ভালো লাগতে শুরু করল। বাড়িতে একটা মেয়েলি মেয়েলি ব্যাপার আছে। বেশ গোছানো একটা বাড়ি। অবশ্য রহিম আসার আগেই জানতো যে চেয়ারম্যান সাহেবের একটি মাত্র মেয়ে। আর কোনো সন্তান নেই। চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়ির চারপাশে টিনের বেড়া দেওয়া আছে, বাড়ির উঠোনের কোণে একটা কাঁঠাল গাছ আছে,মোট ঘর তিনটা।
বাড়ির ভেতরে গিয়ে রহিম মাপজোক নিয়ে যখন বেড়িয়ে আসবে ঠিক তখনি রহিমের সাথে ঘটে যায় অপ্রীতিকর একটা ঘটনা। সে যখন বাড়ির বাইরে চলে যাওয়ার জন্য দরজার সামনে আসলো ঠিক তখনি হুরমুর করে ঘরে ঢুকল চেয়ারম্যান সাহেবের মেয়ে। রহিম একটু সময়ের জন্য ‘থ’ মেরে দাড়িয়ে ছিলো। কি হয়েছে কিছু বুঝে উঠার আগেই মেয়েটি তাড়াহুড়ো করে ভেতর ঘরে চলে গেলো।
ঘটনা এতটুকুর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে হয়তো ভালোই হতো। রহিমের দোকানে যাওয়ার পর থেকেই শুধু মেয়েটার কথা মনে পড়তে লাগলো। একটা মেয়ে যে এতো সুন্দর তা না দেখে বুঝার উপায় নেই। তার মনে হয়েছিলো যে পৃথিবীতে যদি সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে থাকে তাহলে সেই মেয়েটি হলো চেয়ারম্যানের মেয়ে।
সেদিন রাতে রহিম ভালো করে ঘুমোতে পারল না। সারারাত এপাশ ওপাশ করে সময় কেটে গেলো। রাত শেষে যখন ভোরবেলা পূব আকাশে লাল আবছা আলো জ্বলে উঠলো সেই সময় পর্যন্ত রহিম চৌকির এপাশে ওপাশ করল।
সেদিন যখন দোকানে গেলো রহিম আর কিছুতেই কাজে মন বসাতে পারছিলো না।তার মন শুধু মেয়েটাকে দেখতে চাচ্ছে। সারাক্ষণ সে ভাবতে থাকে মেয়েটির কথা। এমনকি সে মনে মনে চাচ্ছিলো আবার চেয়ারম্যানের বাড়িতে যেতে। কিন্তু কোনো অজুহাত ছাড়া তো আর যাওয়া যায় না!
এদিকে ফজল আলী রহিমের দিকে সকাল থেকেই নজড় দিচ্ছে আর বলছে,’ কি মিয়া, আইজকা তো তোমার কামে কোনো রসকষ পাইতাছি না। কোনো ধান্দায় আছো নাকি। ”
রহিম বললো,” আরে না চাচা, কি যে কন আপনে! রাতে ঘুম আসে নাই চৌখে তাই এখন ভালা লাগতেছে না।”
ফজল আলী বললো,”তুমি জোয়ান মানুষ, এখনই চৌখে ঘুম নাই! তুমি মিয়া এক কাম কর, গফুরের দোকান থেইক্কা একটা তাল কিন্না লইয়া যাইও। রাতে রসটা খাইলে দেখবা ঘুমে ক্যামনে ধরে!” রহিম বললো,” আচ্ছা চাচা!”
রহিম মনে মনে ভাবতে থাকে, এতো কোনো অনিদ্রা নয়! এ হলো জগতের সবচেয়ে বড় নিষিদ্ধ টান, যেটা সকল ছেলেরই বোধহয় কোনো না কোনো রাতে হয়। কিন্তু যার জন্যে হয় সে কি জানে??
রহিমের অজান্তেই ওর মনের কোণে মেয়েটার জন্য জায়গা তৈরী হয়ে গেলো। সে কেবলই ভাবতে থাকে কিভাবে আবার সেই সুন্দরী ললিতার দেখা পাওয়া যায়।
একদিন রহিমের ভাগ্য খুলে গেলো। চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়িতে তার ডাক পড়লো। ফজল আলী রহিমকে ডেকে বললো,”চেয়ারম্যানের বাড়ির সু-কেস আর আলমারি উনার বাড়িতে থাইক্কা বানাইয়া দেওন লাগবো। আমি তোমার কথা বইলা দিছি চেয়ারম্যান সাবরে। তুমি ভালো কাম পারো এইডাও উনারে বলছি।”
রহিম ভদ্রতা এবং নিজের আগ্রহকে লুকিয়ে বললো,”চাচা আপনি করলেই তো ভালো হয়!”
ফজল আলী বললো,”আরে মিয়া আমার চৌখের আন্দাজ ঠিক নাই আর আগের মতো। তুমি গেলেই ভালা।”
রহিম বললো,” জ্বি আচ্ছা! “
পরেরদিন সকাল বেলা রহিম চলে গেলো চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়িতে। কাজ করার ফাঁকে ফাঁকে সে উঁকি দিচ্ছে মেয়েটিকে দেখার জন্য! কিন্তু সে মেয়েটির দেখা আর পেল না সেদিন।
এভাবে তিনদিন কাজ করার পর চতুর্থ দিনের মাথায় রহিমের ভাগ্য খুললো। দেখা পেলো ললিতার। সেদিন রহিম কাজ করছিলো বাড়ির উঠোনের কাঁঠাল গাছের নিচে বসে। হঠাৎ ক্ষীণ কন্ঠে কে যেনো বললো,”আপনার চা!”
রহিম তৎক্ষনাৎ তাকিয়ে সেই ললিতার দিকে চেয়ে কয়েক মূহুর্তের জন্য স্তম্ভিত হয়ে গেলো।
মেয়েটি গলা ঝেড়ে কাশির মতো শব্দ করে আবার বললো,”আপনার চা!”
এতক্ষণে রহিম হুঁশে এলো। সে লজ্জা মাখা কন্ঠে বললো,”আপনের নাম কি?”
মেয়েটি হঠাৎ এ ধরণের লাইনচ্যুত প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। আর কিছু না বলে চায়ের কাপ মাটিতে রেখেই একদৌড়ে ভেতর বাড়িতে চলে গেলো।
রহিম এবার ভাবতে লাগলো যে সে কত বড় ভুলটাই না করেছে। তার চিন্তা হতে লাগলো যে, সে কি বলতে কি বলে ফেলেছে। মেয়েটা যদি চেয়ারম্যান সাহেবকে এ ঘটনা বলে দেয়?
খোলা চিঠি/নাজিউর রহমান রাকিব